সূরা বাকারা শেষ দুই আয়াত অনুবাদ,উচ্চারণ,ফযিলত এবং গুরুত্ব

নবী করীম (সাঃ) মিরাজের রাতে  যে তিনটি জিনিস পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল, সূরা বাকারাহর শেষের দুটি আয়াত।(সহীহ মুসলিম) পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা হলো সূরা আল বাকারাহ, যাকে কুরআনে কারীমের চূড়া বলা হয়। সূরা বাকারার মোঠ আয়াত সংখ্যা ২৮৬। এই সূরার শেষের দুটি আয়াতের(২৮৫ ও ২৮৬ নং আয়াত) ফযিলত সম্পর্কিত বহু হাদিস রয়েছে।

হযরত নোমান ইবনে বশীর(রাযিঃ) হইতে বর্নিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, আসমান ও জমিন সৃষ্টির দুই হাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহ্ তায়ালা একটি কিতাব লিখিয়াছেন। উক্ত কিতাব হইতে দুইটি আয়াত নাজিল করিয়াছেন যাহার উপর আল্লাহ্ তায়ালা সূরা বাকারাহ শেষ করিয়াছেন। এই আয়াতদ্বয়(আয়াত দুটি) একাধারে তিন রাত্র যে ঘরে পড়া হয়, শয়তান উহার নিকটেও আসেনা। (তিরমিযী)

 

এমন আরও অনেক ফযিলত রয়েছে সূরা বাকারা শেষ ‍দুই আয়াত এর। তাই চলুন আমরা সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত সম্পর্কিত বিভিন্ন হাদিস,ফযিলত ও এর বাংলা অর্থসহ জেনে নিই।

. সূরা বাকারা শেষ দুই আয়াত উচ্চারণ এবং বাংলা অনুবাদ

 

২৮৫ নং আয়াতঃ

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ

 

উচ্চারণঃ

আমানুর-রাসুলু বিমা উংজিলা ইলাইহি মির রাব্বিহি ওয়াল মু ’মিনুন। কুল্লুন

আমানা বিল্লাহি ওয়া মালা-ইকাতিহি ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসুলিহি, লা নুফার-রিকু বাইনা

আহা’দিম-মির রুসুলিহি। ওয়া ক্বালু সামি’না, ওয়া আত্বা ’না, গুফরা নাকা, রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাসির।

অনুবাদঃ

রসূল বিশ্বাস রাখেন ঐ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যা তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুসলমানরাও সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমুহের প্রতি এবং তাঁর পয়গম্বরগণের প্রতি। তারা বলে আমরা তাঁর পয়গম্বরদের মধ্যে কোন তারতম্য করিনা। তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের পালনকর্তা। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

 

তফসীরঃ

রসূল তার প্রতি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে সে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং বিশ্বাসিগণও; সকলে আল্লাহতে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে এবং তাঁর রসূলগণে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। (তারা বলে, আমরা তাঁর রসূলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না।[১] আর তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার ক্ষমা চাই, আর তোমারই দিকে (আমাদের) প্রত্যাবর্তন হবে।

এই আয়াতে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যার উপর ঈমানদারদেরকে ঈমান আনতে বলা হয়েছে। এর পরের আয়াতে আল্লাহর রহমত, তাঁর দয়া এবং তাঁর অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তিনি মানুষকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না।

হাদীসে এই শেষ দুটি আয়াতের অনেক ফযীলতের কথা এসেছে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সূরা বাক্বারার শেষের দু’টি আয়াত রাতে পড়ে নেয়, তার জন্য এই আয়াত দু’টিই যথেষ্ট হয়ে যায়।” (বুখারী, ইবনে কাসীর) অর্থাৎ, এই আমলের কারণে মহান আল্লাহ তার হেফাযত করবেন।

অপর একটি হাদীসে এসেছে, নবী করীম (সাঃ) মিরাজের রাতে যে তিনটি জিনিস পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল, সূরা বাক্বারার শেষের এই দু’টি আয়াত। (সহীহ মুসলিম) অনেক বর্ণনায় এ কথাও এসেছে যে, এই সূরার শেষের আয়াত দু’টি রসূল (সাঃ)- কে আরশের নীচের একটি ভান্ডার থেকে দেওয়া হয় এবং এই আয়াত কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়, অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। (আহমদ, নাসায়ী, ত্বাবারানী, বায়হাক্বী, হাকেম এবং দারেমী ইত্যাদি।) মুআয (রাঃ) এই সূরা শেষ করে ‘আমীন’ বলতেন।” (ইবনে কাসীর)

 

২৮৬ নং আয়াতঃ

لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

উচ্চারণঃ

লা ইউ কাল্লিফুল্লাহু নাফসান ইল্লা উস-আ ’হা। লাহা মা কাসাবাত ওয়া

আ’লাইহা মাক তাসাবাত। রব্বানা লা-তু আখজিনা-ইন্না সিনা- আও আখত্বা’না।

রাব্বানা ওয়ালা তাহ’মিল আ’লাইনা ইসরান কামা হা ’মালতাহু আ’লাল্লাজিনা মিন

ক্বাবলিনা। রব্বানা ওয়ালা তুহা’ম্মিলনা মা-লা ত্বাকাতালানা বিহ। ওয়াআ ’ফু

আ’ন্না, ওয়াগ ফিরলানা, ওয়ার হা ’মনা। আংতা মাওলানা, ফানছুরনা আ’লাল

ক্বাওমিল কাফিরিন।

অনুবাদঃ

আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে। হে আমাদের পালনকর্তা, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদেরকে অপরাধী করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! এবং আমাদের উপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর অর্পণ করেছ, হে আমাদের প্রভূ! এবং আমাদের দ্বারা ঐ বোঝা বহন করিও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নাই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের কে সাহায্যে কর।

তফসীরঃ

আল্লাহ কাউকেও তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না। যে ভাল উপার্জন করবে সে তার (প্রতিদান পাবে) এবং যে মন্দ উপার্জন করবে সে তার (প্রতিফল পাবে)। হে আমাদের প্রতিপালক! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তাহলে তুমি আমাদেরকে অপরাধী করো না। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পূর্ববর্তিগণের উপর যেমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলে আমাদের উপর তেমন দায়িত্ব অর্পণ করো না। হে আমাদের প্রতিপালক! এমন ভার আমাদের উপর অর্পণ করো না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর, আমাদের পাপ মোচন কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমি আমাদের অভিভাবক। অতএব সত্য প্রত্যাখ্যানকারী (কাফের) সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে (সাহায্য ও) জয়যুক্ত কর।

সূরা বাকারা শেষ দুই আয়াত ফযিলতসমূহ

১. হযরত আবু মাসউদ আনসারী (রাযিঃ) হইতে বর্নিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি কোন রাত্রে সূরা বাকারার শেষ দুই ৮ আয়াত পড়িয়া লইবে তবে এই দুই আয়াত তার জন্য যথেষ্ট হইয়া যাইবে । (তিরমিযী)

ফায়দাঃ দুই আয়াতের যথেষ্ট হওয়ার দুই ورد অর্থ– এক এই যে, উহার পাঠকারী সেই রাত্রে সকল খারাবী হইতে নিরাপদ 1, থাকিবে। দ্বিতীয় এই যে, এই দুই আয়াত তাহাজ্জুতের স্থলে হইয়া যাইবে। (ইমাম নববি)

২. হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) হইতে বর্নিত আছে যে, একবার জিবরাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসিয়াছিলেন, এমন সময় আসমান  হইতে কড় কড় আওয়াজ শুনা গেল। তিনি মাথা উঠাইলেন এবং বলিলেন, আসমানের একটি দরওয়াজা খুলিল যাহা আজকের পূর্বে কখনো খুলে নাই।

এই দরজা দিয়ে একজন ফিরিশতা অবতরন করিয়াছেন। এই ফিরিশতা আজকের পূর্বে কখনো জমিনে আসেন নাই। সেই ফিরিশতা খেদমতে উপস্থিত হইয়া সালাম করিলেন এবং আরজ করিলেন, সুসংবাদ হউক, আপনাকে দুইটি নূর দেওয়া হইয়াছে যাহা আপনার পূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয় নাই। একটি সূরা ফাতিহা, দ্বিতীয়টি সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত। আপনি উহা হইতে যেকোন বাক্য পড়িবেন তাহা আপনাকে দেওয়া হইবে। (মুসলিম)

ফায়দাঃ অর্থাৎ, যদি প্রশংসামূলক বাক্য হয়, তবে প্রশংসা করার সওয়াব পাইবেন, আর যদি দোয়ার বাক্য হয় তবে দুয়া কবুল করা হইবে।

সূরা বাকারা শেষ দুই আয়াত ছবি

সূরা বাকারা শেষ দুই আয়াত পিডিএফ

 

ডাউনলোড সূরা বাকারা শেষ দুই আয়াত পিডিএফ

 

সূরা বাকারা শেষ দুই আয়াত গুরুত্ব

হযরত মাকেল ইবনে ইয়াসার (রাযিঃ) হইতে বর্নিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, কুরআনে কারীমের চূড়া অর্থাৎ সর্বোচ্চ অংশ হইল সূরা বাকারাহ। উহার প্রত্যেকের সহিত আশিজন ফেরেশতা অবতরন করিয়াছেন এবং আয়াতুল কুরসী আরশের নিচ হইতে বাহির করা হইয়াছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তায়ালার বিশেষ খাজানা হইতে নাজিল হইয়াছে।

অতঃপর উহাকে সূরা বাকারার সহিত মিলাইয়া দেওয়া হইয়াছে–অর্থাৎ উহার মধ্যে শামিল করা হইয়াছে । সূরা ইয়াসিন কুরআনে কারীমের দিল। যে ব্যক্তি উহাকে আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন এবং আখিরাতের নিয়তে পড়িবে অবশ্যই তাহার মাগফিরাত করিয়া দেওয়া হইবে । অতএব এই সূরা নিজেদের মরনাপন্ন লোকদের নিকট পাঠ কর (যেন রূহ বাহির হইতে সহজ হয়)। (মুসনাদে আহমাদ

ফায়দাঃ হাদীস শরীফে সূরা বাকারাকে কুরআন কারীমের চূড়া সম্ভবতঃ এইজন্য বলা হইয়াছে যে, ইসলামের বুনিয়াদী উসূল, আকীদাসমূহ ও শরীয়তের হুকুমসমূহের বিস্তারিত বর্ননা যেরূপ সূরা বাকারাতে করা হইয়া এই পরিমান ও এরূপ কুরআনে কারীমের আর কোন সূরায় করা হয় নাই। (মাআরিফে হাদীস)

Leave a Comment